Prem - Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ (motivational books for students TXT) 📗
- Author: Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ
Book online «Prem - Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ (motivational books for students TXT) 📗». Author Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ
আমি ভয় পাচ্ছি না। ভয়ের ব্যাপার ছিল কিনা, বা এখনো ভয় পাওয়া উচিত কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি যে রামালাকে ভয় পাচ্ছি না, মূল বিষয় হলো এটা। পূর্ব জন্মটন্ম নিয়ে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। রামালা এখন অত্যধিক ঘোরের ভেতর প্রলাপ বকছে। ও আমাকে কত গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তা এই আজগুবি প্রলাপ থেকেই বুঝতে পারছি।
তবে, ওর একটা বিষয় আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করলো।
এটা একটা অভিনব আইডিয়া বটে। মানুষের ব্রেইন কোনোদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব হবে কিনা, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান সেটা জানবে। তবে, ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের চাইতে একচিলতে মেমোরি কার্ডের ভেতর একটা মানুষের সমগ্র স্মৃতিসম্ভার, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা জড়ো করা সহজতর কাজ। ‘ডাইনি’ রামালা কি সে-ধরনের কিছু করতে যাচ্ছে? এতে মানবজাতির কী উপকার সাধিত হবে, ওকেই তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে।
‘হ্যাঁ, সেটাই বলছি।’ ওরে সর্বনাশ! আমার মনের কথা রামালা ধরে ফেলছে দেখি!
‘হ্যাঁ, এখন তুই আলাদা করে কিছু ভাবতে পারবি না।‘ ঠান্ডা গলায় রামালা বলে উঠলো।
‘প্রথম দিকে কৃত্রিম উপায়ে বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে একটা সূক্ষ্ম মেমোরিকার্ডে ঢোকানো হবে। এই মেমোরিকার্ডটি মাথার একপাশে চামড়ার নীচে গেঁথে দিতে হবে। সেকেন্ড জেনারেশন স্টেজে আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিন্সসহ প্রতিভাধর জীবিত ব্যক্তিদের ডিএনএ থেকে তাদের বুদ্ধিমত্তা সংগ্রহ করে একত্র করা হবে। একত্রিত বুদ্ধিমত্তাকে কনসেন্ট্রেট করে মূল বুদ্ধিমত্তার চাইতে বহুগুণ শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা হবে। এগুলো অনুরূপ এক-চিলতে চিপসে ঢোকানো হবে। এগুলো কপি করা যাবে। মেধাবীদেরকে আরো মেধাবী এবং অমেধাবীদেরকে মেধাবী করার কাজে এ চিপস ব্যবহৃত হবে। থার্ড জেনারেশন স্টেজে চিপসকে লিকুইড ফর্মে রূপান্তর করা হবে। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বুদ্ধিমত্তা পুশ করা হবে। ফলে হবে কী, পৃথিবীতে স্টিফেন হকিন্সের প্রতিভার পুনরাবির্ভাব ঘটবে। আইনস্টাইন, নিউটনের পুনরাগমন ঘটবে। মানব সভ্যতা সক্রেটিস, এরিস্টটলের মতো দার্শনিকদের মেধা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতিভার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক মহামানবীয় প্রতিভা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। উন্নত বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে মানবসভ্যতার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকবে। ফোর্থ জেনারেশন স্টেজে সংগৃহীত সমন্বিত প্রতিভার চিপসটি বায়বীয় কিংবা ‘লাইট’ ফর্মে রূপান্তর করা হবে। চোখের দৃষ্টি দিয়েই একজনের বুদ্ধিমত্তা অন্যজনের শরীরে ট্রান্সফার করা যাবে। আমরা যত্রতত্র রামালার মতো অসংখ্য সুকণ্ঠী গায়িকাকে দেখতে পাবো…’। আমার মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর এই যে ভাবনাগুলো কিলবিল করছে, এটা আমি না, রামালার ভাবনা। রামালার মগজ এখন আমার মগজে ঢুকে পড়েছে। আমার কথাটা রামালার, এবং রামালার কথাটা আমার, এবং আমাদের দুজনের কথাটাও… নাহ, আর ভাবতে পারছি না।
‘সোনা!’ রামালার কথায় আমি সম্বিৎ পাই। একটা জলবতী স্নিগ্ধ কবিতা এক অপরূপ ভঙিমায় আমার সামনে বসে আছে। ওর মুখের হাসিটিতে পৃথিবী মধুর হয়ে উঠছে।
এখন দিন, নাকি রাত, আমরা জানি না। কোথায় আছি আমরা জানি না। আমরা হাত ধরে মুখোমুখী বসে আছি। চারদিকে অন্ধকার, নাকি জোসনা, আমরা ভুলে গেছি। ভুলতে ভুলতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন আমি এবং রামালা দুজনেই ক্লাসে। একজন সাহিত্যের শিক্ষক বোর্ডে বেশকিছু অদ্ভুত আকৃতির ছবি এঁকে বলছেন, ‘এরা হলো অন্যগ্রহের মানুষ। অন্যগ্রহের মানুষ দেখতে আমাদের মতো নয়; কেউ পাথর, কেউ পাহাড়, কেউ গাছের মতো, কেউ-বা বায়বীয় বা তরল পদার্থের মতো; কেউ আবার এমন, যাদের আকৃতি আমাদের কল্পনার অতীত। এদের চলাচলও কিন্তু আমাদের মতো না; এরা কল্পনাগামী, অর্থাৎ, এরা যেখানে যাবার কথা কল্পনা করে, মুহূর্তে সেখানেই চলে যায়। এরা একই সাথে অনেক জায়গায় অবস্থান করতে পারে; যার কল্পনাশক্তি যত বেশি, সে তত বেশি জায়গায় এবং তত বেশি দূরবর্তী স্থানে যাতায়াত ও অবস্থান করতে পারে। আমাদের পৃথিবীতেও মানুষ একদিন কল্পনাগামী হবে। প্রথমে তারা বাতাস, পরে ইথারে ভ্রমণ করতে পারবে। এরপর তারা…’
রামালা হঠাৎ দাঁড়িয়ে স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকলো, ‘স্যার, এ গল্পগুলো প্লিজ না করুন। ইউনিভার্সের অন্য কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ইউনিভার্সে পৃথিবীর মতো ৪০ বিলিয়ন গ্রহ এবং অগুনতি উপগ্রহ আছে। পৃথিবীর বয়সই ৫০০ কোটি বছর। ইউনিভার্সের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। ৫০০ কোটি বছরে যদি পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ ঘটতে পারে, ১৪ বিলিয়ন বছরে অনেক আগেই ইউনিভার্সের অন্য কোথাও প্রাণীর সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে আজও কোথাও প্রাণের সন্ধান পৃথিবীর মানুষ পায় নি; অন্য কোথাও প্রাণী থাকলে তাদের আমাদের চাইতেও বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার কথা, যেহেতু ইউনিভার্সের বয়স পৃথিবীর বয়সের চাইতে অনেক বেশি। এবং আমরা তাদের খুঁজে না পেলেও অন্তত তারা এতদিন আমাদের খুঁজে বের করে ফেলতো।’ আশ্চর্য, পুরো ক্লাস হাততালি দিয়ে উঠলো, এবং স্যার অবাক হয়ে রামালার দিকে তাকিয়ে আছেন।
এবং রামালা, না, রামালা না, হ্যাঁ, রামালা আমার মগজে ঢুকে পড়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘স্যার, আপনি সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে বিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন, এটা হাস্যকর বটে।‘
শিক্ষক আহত হলেন না, কিংবা তার কোনো ভাবান্তর হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘ডিয়ার সান, আমি সাহিত্যের শিক্ষক বলেই এতখানি কল্পনা করতে পেরেছি। এখন বিজ্ঞানের যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে আমার কল্পনাকে ছুঁয়ে দেখুক।’ রামালা চুপসে গেল, না, আমিই আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ক্লাসে কোনো শব্দ নেই। কেউ নেই ক্লাসে। বোর্ডের সামনে একটা ব্ল্যাক মার্কার হাতে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রামালা।
৩
সকালে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একটা গান গাইছিলাম। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সুন্দরী হেলেনা বলে উঠলো, ‘বাহ, তোমার কণ্ঠটা দারুণ তো!’ তাই তো! আমি নিজেই অবাক হচ্ছি আমার কণ্ঠ শুনে। হেলেনার কথায় আমি খুব পুলকিত হই। ওর চোখে মুগ্ধতার ঝিলিক। আমি আরো গলা ছেড়ে, আরো যত্ন করে গান গাইতে থাকি। গান গাওয়া শেষ হলে দেখি, হেলেনা আমার কাঁধের উপর মাথা নুইয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে আছে।
‘গাও না বাবু, গাও। আরো গাও।‘
আমি একের পর এক গান গাইতে থাকি। নিজের গানে নিজেই মুগ্ধ হতে থাকি। এবং অবাক হতে থাকি- আগে তো কখনো এভাবে গাইতে পারি নি!
আমার গানে হেলেনা পাগল হয়ে গেল।
যখন তখন হেলেনা আমাকে গান গাইতে বলে।
যেখানে-সেখানে হেলেনা আমার গলায় গলায় জড়িয়ে থাকে।
আমাকে ছাড়া কিচ্ছুটুকুন বোঝে না হেলেনা। প্রেমে পাগলিনী এমন মেয়েদের কার না ভালো লাগে?
একদিন গান গাওয়ার পর আবেশে জড়িয়ে ধরে অনর্গল চুমো খেতে থাকে হেলেনা। আমি ওকে বুকে টেনে নিই। ওর চোখে চোখ রাখি। খুব গভীরভাবে ওর মণি বরাবর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিই। তারপর ওর মগজে ঢুকে পড়ি। হ্যাঁ, আমি রামালা। হেলেনার মগজ খুবলে ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে আসি।
৪
বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বারান্দায় গ্রিল ধরে সন্ধ্যারাঙা বৃষ্টি ঝরা দেখছে রামালা। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁইছে। পিঠের উপর একগাঁদা চুল ছড়িয়ে পড়েছে। চুলের সাথে আঁচল উড়ছে বাতাসে। রামালা আমাকে ডাকছে না ওর কাছে যেতে। ও না ডাকলে আমি কখনো কাছে যাই না।
ও প্রতি উইকএন্ডে আমাকে গান শোনাতে আসে। সারাদিন নানান জায়গায় গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আজকে এই অনুষ্ঠান, কালকে ওখানে ওপেন এয়ার কনসার্ট, টিভিতে লাইভ প্রোগ্রাম! ওর ব্যস্ততার শেষ নেই। ও এখন দেশের সেরা শিল্পীদের একজন। আমাকে যদি একজন শিল্পীর নাম বলতে বলো, আমি বলবো সে রামালা। আমার ভালো লাগে রামালার গান। রামালা যখন আধো নিমীলিত চোখে গান গাইতে থাকে, তখন ওকে ধ্যানী সন্ন্যাসিনী মনে হয়। তখন সাধ হয়, ওর কোলের উপর মাথা রেখে ওর গলা ধরে ঝুলে থাকি।
রামালা আমার বাসায় খালি গলায় গান গায়। বাসায় কোনো গিটার কিংবা হার্মোনিয়াম নেই। এসব থাকলেও আমি ওর খালি গলায় গাওয়া গানই শুনতাম। এতেই ওর প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। ওর কণ্ঠে অমৃত ঝরে পড়ে, আমি তাতে গলে যাই, আর মিশে যেতে থাকি।
‘শোন!’ এটা রামালার কাছে যাবার ইঙ্গিত।
আমি রামালার পেছনে যেয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াই। আমার দু’হাত ওর দু’দিকে প্রসারিত দু’হাতের উপর মেলে ধরি। রামালার শরীর আস্তে সামান্য ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে সামনে বারান্দার গ্রিল দরজা খোলার মতো খুলে গেল, রামালা একটু ঝুঁকে পড়ে আলগোছে শূন্যে ঝাঁপ দিল। পড়তে পড়তে দু’দিকে দুটো ডানা মেলে ধরলো আকাশে। তারপর বাতাসের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে বৃষ্টির পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমাকে পৃষ্ঠে সওয়ার করে আকাশে উড়তে থাকলো রামালা। হিম হয়ে আসে শরীর। আমি রামালাকে শক্ত করে জড়িয়ে ওর শরীরের ওম নিতে থাকি। কখনো উর্ধে উঠে যাই ঈগলের মতো, আবার ঢেউয়ের মতো দুল খেতে খেতে নীচে নামতে থাকি। কতদিনের বাসনা ছিল আকাশে ওড়ার, ভূ-পৃষ্ঠে কুয়াশাচ্ছন্ন বনানি দেখার, আজ আমি প্রাণ ভরে সেসব দেখছি। পাহাড়, নদী পেরিয়ে, বৃষ্টি আর আকাশের শূন্যতা কেটে রামালা আমাকে নিয়ে উড়ে চলেছে। কখনো বাতাসের বেগে, কখনো আরো দ্রুত। আমার গ্রামকে মনে পড়লো, আর এ কী অদ্ভুত! মুহূর্তেই দেখতে পেলাম, আমি আমার গ্রামের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই তো, এই মাঠে আমি, নূরু, জসীম- একসাথে কত খেলেছি! অমনি দেখতে পাই, ওরা আমার সামনে এসে হাজির। আমরা মাঠের মাঝখানে বসে বিকেলের নরম আলোতে আড্ডা দিচ্ছি আর চানাচুর খাচ্ছি।
‘মা!’ বলতেই নিজেকে দেখতে পাই, আমি এক ৭ বছরের খোকা। উঠোনে বাতাসে ধান ঝাড়ছে মা, আর আমরা ভাইবোনেরা ধানের খড়ে লাফালাফি করে খেলা করছি। একদিন বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিল। কী তুখোড় আর উদ্দাম এই দিনগুলো! ভোঁ ভোঁ দৌড়াই, সারাদিন ঘুড়ি নিয়ে মাতামাতি, গাছগাছালির ফল কুড়িয়ে বেড়াই, পাখির বাসায় হানা দিই, যখন-তখন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হলডুগানি খেলি। এভাবে কতদিন কেটে যায়, আমার হিসাব থাকে না। স্কুলে যাওয়ার পথেই একটা ডঙ্গুল ফলের গাছে। আমি, নুরু আর জসীম প্রতিদিন সেই গাছ থেকে ফল পাড়ি। চলে যাওয়ার সময় বাড়ির আড়াল থেকে গলা বের করে ছোট্ট চোখে একটা মেয়ে তাকিয়ে থাকে, ওর নাম হেলেনা।
‘সোনা!’ কার ডাক শুনে চোখ খুলে ঘুরে তাকাই।
চারদিকে আলোর সমুদ্র থইথই করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে পরীরা। ওরা আমার পাশ দিয়ে উড়ে যায়, ওদের পাখার নরম ঝাপটায় আমার মন আন্দোলিত হয়। হেলেনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, খুব মিষ্টি করে হাসছে হেলেনা।
২৩ জুন ২০২০
ImprintText: Khalil Mahmud
Images: Khalil Mahmud
Cover: Khalil Mahmud
Editing: Khalil Mahmud
Translation: Khalil Mahmud
Layout: Khalil Mahmud
Publication Date: 07-28-2020
All Rights Reserved
Comments (0)